যেভাবে মিলবে স্টারলিংকের ইন্টারনেট, যা যা সুবিধা থাকবে


Desk News প্রকাশের সময় : মে ২০, ২০২৫, ৭:৫৭ অপরাহ্ন /
যেভাবে মিলবে স্টারলিংকের ইন্টারনেট, যা যা সুবিধা থাকবে

স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ইন্টারনেট সেবার কোম্পানি স্টারলিংক বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে সেবা শুরুর পর সেবাটি নিয়ে নানা প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টায় রয়েছে মানুষ।

কারা, কীভাবে, কত টাকা খরচ করে নেওয়া যাবে এই সেবা, কী কী সুবিধা পাওয়া যাবে- এমন নানা প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব। ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব এক ফেইসবুক পোস্টে লিখেছেন, বাংলাদেশের গ্রাহকরা মঙ্গলবার থেকেই স্টারলিংক ইন্টারনেট সংযোগের অর্ডার করতে পারবেন।

বাংলাদেশে স্টারলিংকের বাণিজ্যিক যাত্রার বিস্তারিত জানাতে দুপুরে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সংবাদ সম্মেলনে আসেন তৈয়্যব; সঙ্গে ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম ও উপ-প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার।

তৈয়্যব বলেন, স্টারলিংকের একটি ৪৭ হাজার টাকা দামের সেটআপ একটি মোবাইল টাওয়ারের সমান ইন্টারনেট সরবরাহ করতে পারবে। যার ফলে প্রত্যন্ত অঞ্চলে মানসম্পন্ন ইন্টারনেট দেওয়া সহজ হবে। আর ফ্রিল্যান্সার, উদ্যোক্তা বা ইন্টারনেটনির্ভর কাজ করেন এমন ব্যক্তি ও সংস্থা নিরবচ্ছিন্ন উচ্চগতির ইন্টারনেট পাবেন। বাংলাদেশে এখনো স্টারলিংকের গ্রাউন্ড স্টেশন তৈরি হয়নি।

বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব তার সকালের ফেইসবুক পোস্টেই বলেছিলেন, স্টারলিংক শুরুতে দুটি প্যাকেজ দিয়ে বাংলাদেশে সেবা শুরু করছে- স্টারলিংক রেসিডেন্স এবং রেসিডেন্স লাইট। মাসিক খরচ একটিতে ৬০০০ টাকা, অন্যটিতে ৪২০০ টাকা। তবে সেটআপ যন্ত্রপাতির জন্য ৪৭ হাজার টাকা এককালীন খরচ হবে।

তিনি বলেন, স্টারলিংকের ওয়েবসাইট থেকেই সেবার গ্রহণের অর্ডার করা যাবে। যন্ত্রপাতির মধ্যে থাকবে একটি স্যাটেলাইট ডিশ অ্যান্টেনা, ওয়াইফাই রাউটার, মাউন্টিং ট্রাইপড ও প্রয়োজনীয় কেবল।

এই যন্ত্রপাতিগুলো সহজে স্থাপনযোগ্য এবং স্থাপন করা শেষ হলেই গ্রাহক ইন্টারনেট ব্যবহার শুরু করতে পারবেন। সংবাদ সম্মেলনের শুরুতেই স্টারলিংক নিয়ে মানুষের সাধারণ কিছু প্রশ্নের লিখিত উত্তর পড়ে শোনান ফয়েজ আহমদ। প্রথম প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, স্টারলিংক ইন্টারনেটে কোনো ডেটা লিমিট নেই।

ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় এখনো অপটিক্যাল ফাইবার পৌঁছায়নি। মাত্র ৩০ শতাংশ মোবাইল টাওয়ারে ফাইবার আছে। মোবাইল কোম্পানিগুলোর যে সেবা সেটা মাইক্রোওয়েভের মাধ্যমে হয়, যেটা লো ক্যাপাসিটির।

তিনি বলেন, বাংলাদেশে এখনও হাজার হাজার মোবাইল টাওয়ার আছে যারা শুধু ৩০০ এমবিপিএসের ব্যান্ডউইডথ দিযে একটা মোবাইল টাওয়ার সচল রাখে ইন্টারনেটের জন্য এবং সেই ডেটা ইন্টারনেটটা কয়েক হাজার গ্রাহকের কাছে বিক্রি করা হয।

স্টারলিঙ্কের ক্ষেত্রে মাত্র একটা সেটআপ বক্স দিয়ে এই সমস্যার সমাধান হবে জানিয়ে এর ব্যাখ্যায় তৈয়্যব বলেন, “অর্থাৎ গ্রামের একজন উদ্যোক্তা উনি স্টারলিংকের একটা সেটআপ বক্স যেটা ৪৭ হাজার টাকা দিয়ে কিনবেন, উনি নিজে নিরবচ্ছিন্ন, লো লেটেন্সি এবং উচ্চগতির ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারবেন। লো লেটেন্সি অর্থাৎ ডাউনলোড করতে কম সময় খরচ হবে।

“এক্ষেত্রে লক্ষ্যণীয় যে, সংসদ ভবনে কিংবা মাননীয় উপদেষ্টার বাসভবন বা তার অফিসে যে স্পিডের ইন্টারনেট ব্যবহার করা হয়, ঠিক একই স্পিডে দেশের প্রত্যন্ত ও দূরবর্তী অঞ্চল যেমন পার্বত্য অঞ্চল, হাওরাঞ্চল কিংবা বনাঞ্চলে যেকোনো গ্রাহক উচ্চগতির ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারবেন। এটি ডিজিটাল বৈষম্য রোধে একটা কার্যকর পদক্ষেপ বলে আমরা মনে করি।”স্টারলিংক কি উদ্যোক্তা বান্ধব? উদ্যোক্তারা কীভাবে স্টারলিংক সেবা দেবেন?

এই প্রশ্নে ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, “আমরা এনজিএসও’র বিধিবিধান এমনভাবে করেছি যেন স্টারলিংক বা সমজাতীয় ইন্টারনেট সুবিধা উদ্যোক্তা বান্ধব হয়। অর্থাৎ, একজন উদ্যোক্তা কিংবা একাধিক উদ্যোক্তা নিজেরা যদি ৪৭ হাজার টাকার একটা তহবিল গঠন করে এই তহবিলের মাধ্যমে ইন্টারনেট সেটআপ বক্স কিনবে। এর মাধ্যমে তারা তাদের আশপাশের দোকানে এই ইন্টারনেট বিক্রি বা সেবা দিতে পারবে।

“ওয়াইফাই রেঞ্জ আনুমানিক ২০ থেকে সর্বোচ্চ ৫০ মিটার, এই ৫০ মিটার জোনের মধ্যে বাংলাদেশের গ্রামের গ্রোথসেন্টারগুলোতে অনেক দোকানপাট থাকে। সেখানে সহজেই ইন্টারনেট সেবা এক ব্যক্তি বা একাধিক ব্যক্তি সমিতি আকারে কিনে সেটর মাল্টিপল ব্যবহার সম্ভব। আইনে কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়নি। এছাড়া শহরের বাসভবনে ওয়াইফাই শেয়ারিং করে ইন্টারন্টে ব্যবহার সম্ভব। স্টারলিঙ্কে যেহেতু বিল্টইন রাউটার আছে সেহেতু রাউটার হতে রাউটারে আইএসপি সেটাপেও ব্যবহার সম্ভব।”

ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান কিংবা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে উদ্যোক্তাদের অর্থায়ন করে, সে চেষ্টাও করা হবে বলে জানান তিনি। পাশাপাশি যারা নাগরিক সেবার উদ্যোক্তা হবেন, তাদের জন্য স্টারলিংক কীভাবে সহজে নেওয় যায়- সেজন্য অর্থায়ন প্যাকেজ করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে বলেও জানান তৈয়্যব।

“স্টারলিংকের দাম কিছুটা বেশি। মাসিক খরচ ছয় হাজার এবং চার হাজার দুইশ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে, এটা আমরা স্টারলিংকে কিছুটা নেগোসিয়েশন করে কমিয়েছি। কিন্তু যেহেতু এটা শেয়ার করা যাবে, শেয়ার করার ওপর যেহেতু আমরা বিধিনিষেধ রাখিনি এবং বিক্রি করার উপরও বিধিনিষেধ রাখিনি, সেজন্য এই ইন্টারনেট দিয় সফল ব্যবসা মডেল, এসএমই বা ব্যবসা মডেল তৈরি করা সম্ভব।”

বিশেষ সহকারী বলেন, “পাশাপাশি কেউ যদি এই স্টারলিংক ব্যবহার করে (মোবিলিটি এবং রোমিং সুবিধা ছাড়া) সেটাকে ফিড করে ব্যবহার করে সেখানেও আমরা কোনো বাধা রাখিনি। অর্থাৎ বাংলাদেশের এসএমই কিংবা উদ্যোক্তা বিকাশে সব ধরনের ফ্যাসিলিটি আইন, আইনগত ফ্যাসিলিটেশন রাখা হয়েছে।

“এর বাইরে আমরা সবাই প্রফেসর ডক্টর মুহম্মদ ইউনূসের ফোন লেডি কনসেপ্টে বড় হয়েছি। স্টারলিংকের মাধ্যমে আমাদের মাইক্রোক্রেডিট কিংবা ইএমআই অথবা যেকোনো এমএফআই/এমআরএ পদ্ধতিতে ফাইন্যান্সিয়াল অর্গানাইজেশনগুলো চাইলে ওয়াইফাই লেডি হিসেবে নতুন একটা উদ্যোক্তার ধারা সৃষ্টি করতে পারে। তারা চাইলে শুধু গ্রামীণ মহিলাদেরকে একটা বিশেষ ঋণ দিতে পারে, যে ঋণের মাধ্যমে তারা স্টারলিংক নিয়ে ইন্টারনেট সেবা বিক্রি করতে পারেন। সেক্ষেত্রে ভবন ছাড়াও ইনফরমাল কো-ওয়েবিং বিজনেসের মাধ্যমে এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে পারবেন।”

ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, স্টারলিংকের একটি লোকাল গেটওয়ে থাকবে। এখন এর কমার্শিয়াল টেস্ট রান ও গ্রাউন্ড টেস্ট চলমান। এসব কার্যক্রম সম্পন্ন করার জন্য স্টারলিংক কোম্পানিকে ৯০ দিনের সময় দেওয়া হয়েছে, যার দশ দিন গত হয়েছে।

“৯০ দিন অতিবাহিত হলেই তাদের লোকাল গেইটওয়ে বাধ্যতামূলক হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। এর ফলে জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। পাশাপাশি ডিভাইসের ক্ষেত্রে রেট, ভ্যাট, ট্যাক্স আছে, তাই ডিভাইসের বিষয়ে এনওসি নিবে।”

চলমান চীন-মার্কিন বাণিজ্য দ্বন্দ্বের মধ্যে স্টারলিংকের ব্যবহারে অনুমতি প্রভাব পড়বে? বাংলাদেশে ফোর বা ফাইভ-জি টেকনলোজিতে সর্বাধুনিক নেটওয়ার্ক ও ব্যাকবোন স্থাপনে চীনা প্রযুক্তিই ব্যবহার করা হচ্ছে বলে জানান তৈয়্যব।

এছাড়া বিটিসিএল, টেলিটক সংস্থার অধীনে চীনা অর্থায়নে ও প্রকৌশলীদের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন চলছে জানিয়ে তিনি বলেন, “বাংলাদেশের মোবাইল কোম্পানির ভেন্ডর হিসেবেও অনেক চীনা কোম্পানি কাজ করছেন। আমরা চাই, চীন কিংবা মার্কিন ব্যবসায়ীরা যেন স্বাধীনভাবে এখানে জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করে উন্মুক্তভাবে ব্যবসা করতে পারেন। চীনা কোম্পানি জিডব্লিউ যদি আসতে চায় তারাও একই সুবিধা প্রাপ্ত হবে। উল্লেখ্য অন্যান্য দেশের কিছু কোম্পানি যেমন অ্যামাজন কুইপার, টেলিস্যাট, স্যাটেলয়েট এবং ওয়ানওয়েব আগ্রহ দেখিয়েছে। তারা এখানে ব্যবসা করলে আমরা তাদেরকেও একই রকম পলিসি সুবিধা দিতে প্রস্তুত।”

আবাসিক গ্রাহকদের জন্য স্টারলিংক এর দাম কি সহনীয়? এই প্রশ্নে প্রধান উপদেষ্টার তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক বিশেষ সহকারী বলেন, একটা ভবনে ইন্টারনেট ব্যবহার করে এমন অনেকগুলো অ্যাপার্টমেন্ট, কন্ডোমিনিয়াম, ফ্ল্যাট থাকে। বেশ কয়েকটা অ্যাপার্টমেন্ট যারা পাশাপাশি থাকে, চারটা বা পাঁচটা অ্যাপার্টমেন্ট বা দুই-একটা তলা মিলে এই সার্ভিস ব্যবহার করতে পারে, তবে এক্ষেত্রে রেঞ্জ সর্বোচ্চ ২০ মিটার করতে পারবেন।

“সবকিছু মিলিয়ে উদ্যোক্তাদের জন্য এবং কনজ্যুমারদের জন্য এককালীন দামটা বেশি হলেও, সেটআপ কস্টটা বেশি হলেও আমার মনে হয় এটা যখন ডিস্ট্রিবিউটেড হয়ে যাবে অর্থাৎ সমবায় ভিত্তিতে হবে তখন এটা (ব্যয়) খুব বেশি অনুভূত হবে না।”

স্টারলিংকের ব্যয় কি বাংলাদেশে বেশি?

তৈয়্যব বলেন, “আমরা রিজিওনাল প্রাইস অ্যানালাইসিস করে দেখেছি, রিজিওনাল প্রাইসের তুলনায় বাংলাদেশে স্টারলিংকের দাম সবচেয়ে কম। এমনকি শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ডের চেয়েও কম। সো, আমরা এটা (দাম) রেখেছি, যাতে সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে থাকে। যেহেতু বিষয়টা শেয়ার্ড হবে, একক ব্যক্তি যিনি কিনবেন, যিনি ব্যয় নির্বাহ করবেন তার জন্য দাম বেশি হলেও শেয়ারিংয়ে কোনো সীমা না থাকায় একাধিক শেয়ারিংয়ে দাম কমে আসবে।”

সরকারি কোম্পানির স্বার্থ কীভাবে রাখা হচ্ছে- সবশেষ এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দুইভাবে সরকারি কোম্পানির স্বার্থ সংরক্ষণ করা হচ্ছে। প্রথমত, সরকারি সাবমেরিন কেবল কোম্পানির মাধ্যমে এবং দ্বিতীয়ত স্যাটেলাইট কোম্পানির মাধ্যমে।